টাইফয়েড গণহারে টিকা দেওয়ার সতর্কতা
শিশুর ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ।টাইফয়েড টিকার আসল সত্য! আক্রান্তের হার ১%-এর নিচে হলেও কেন গণহারে টিকাদান? ICDDR,B-এর পরিসংখ্যান, ৮৫% সুরক্ষার দাবি এবং টিকা নিলে ১৫% ঝুঁকির ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা।

পেজ সূচীপত্রঃ টাইফয়েড গণহারে টিকা দেওয়ার সতর্কতা
- বাংলাদেশে টাইফয়েড সংক্রমণের অবস্থা
- টিকার কাজঃ ১৮ মাসেই মেয়াদ শেষ
- ঝুঁকির হিসাবঃ ১% বনাম ১৫%
- টাইফয়েড রোগটা আসলে কেমন?
- সবার জন্য টিকার দরকার আছে কি?
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নাকি সুরক্ষাঃ কোনটা বেশি?
- কাদের স্বার্থে এই টিকার কারবার?
- শরীরে জীবাণুর অংশ ঢুকানোর ব্যাপারটা জেনে নিন
- সরাসরি রক্তে কিছু মেশানো ও ইসলাম ধর্মে কি বলা আছে
- শেষ কথাঃ টাইফয়েড গণহারে টিকা দেওয়ার সতর্কতা
বাংলাদেশে টাইফয়েড সংক্রমণের অবস্থা
আইসিডিডিআর,বি (ICDDR,B) সম্প্রতি একটা গবেষণা করে দেখেছে, বাংলাদেশে টাইফয়েড হওয়ার হার আসলে খুব বেশি না। ধরুন, ১ লাখ মানুষে মাত্র ৯১৩ জনের মতো মানুষ এই রোগে ভোগেন। এই সংখ্যাটা শতকরা হিসাবে ১%-এর চেয়েও কম, মাত্র ০.৯১৩%। মানে, ৯৯%-এর বেশি মানুষ এমনিতেই টাইফয়েড থেকে ভালো আছেন। তাই অনেকে ভাবতেই পারেন যে, এত কম মানুষ যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে টিকার দরকারটা কী? এই তথ্য নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।
টাইফয়েড আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও রোগটা কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য একটা মাথাব্যথা। বিশেষ করে যেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা ভালো পানির অভাব আছে, সেখানে এই রোগ সহজে ছড়ায়। কম সংখ্যায় আক্রান্ত হলেও, রোগটা কিন্তু গুরুতর আকার নিতে পারে। তাই এটাকে পুরোপুরি ফেলে দেওয়া যায় না। সংক্রামক রোগ যেহেতু, তাই এর সামান্য উপস্থিতি নিয়েও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ভালো থাকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই দরকারি।
টিকার কাজঃ ১৮ মাসেই মেয়াদ শেষ
গবেষণায় দেখা গেছে, টাইফয়েডের একটা ডোজ টিকা সর্বোচ্চ ১৮ মাস পর্যন্ত নাকি ৮৫% সুরক্ষা দিতে পারে। তবে এই ৮৫% সুরক্ষা নিয়ে অনেকের মনেই কিন্তু প্রশ্ন আছে। মানে, এই সুরক্ষার মেয়াদ খুব বেশি দিন নাও থাকতে পারে। এত অল্প সময়ের জন্য সুরক্ষা পেতে যদি এত বড় পরিসরে টিকা নিতে হয়, তাহলে এর যৌক্তিকতা কী? বারবার টিকা নেওয়ার দরকার হতে পারে। টিকার আসল উপকারিতা যাচাই করা খুব জরুরি।
আরো পড়ুনঃ হার্ট সুস্থ রাখার জন্য সম্পূর্ণ নির্দেশিকা
টিকার কাজ করার ক্ষমতা যদি ৮৫% হয়, তার মানে হলো টিকা নিলে আপনার রোগ হওয়ার ঝুঁকি ৮৫% কমে যাবে। এর মানে এটা নয় যে, টিকা নেওয়ার পর বাকি ১৫% মানুষের অবশ্যই টাইফয়েড হবে। এই ধারণাটা একদম ভুল। বরং, যেহেতু এমনিতেই আক্রান্ত হওয়ার হার কম (০.৯১৩%), তাই টিকা নিলে আক্রান্ত হওয়ার আসল ঝুঁকি আরও কমে (প্রায় ০.১৩৭%)। সুরক্ষা আর আসল আক্রান্তের ঝুঁকি—এই দুইটা ব্যাপার কিন্তু আলাদা। টিকা মূলত ঝুঁকি কমানোর জন্য।
ঝুঁকির হিসাবঃ ১% বনাম ১৫%
টিকা না নিলে টাইফয়েড হওয়ার ঝুঁকি দেশে বড়জোর ১% (আসলে তো ০.৯১৩%)। এই হারটা এত কম যে, অনেকে মনে করতেই পারেন টিকার ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই রোগমুক্ত, তাই টিকা নেওয়াটাকে অনেকেই বাড়াবাড়ি মনে করতে পারেন। এত কম ঝুঁকির জন্য সবার জন্য টিকা আনাটা কতটা ঠিক, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। এই সংখ্যাটা সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে।
অন্যদিকে, আপনি যেটা বলছেন যে টিকা নিলে সর্বোচ্চ টাইফয়েড হতে পারে ১৫%, এটা ভুল বোঝাবুঝি। এটা হলো টিকার যে ১৫% কাজ করতে পারল না, সেই সংখ্যা। এই ১৫% ব্যর্থ সুরক্ষা তো আর ০.৯১৩% আক্রান্তের হারের ওপর গিয়ে পড়লে সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যায় না। আসল হিসাব করলে বোঝা যায়, ঝুঁকি অনেক কম। ভুল তথ্য যেন না ছড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। সঠিক ব্যাখ্যা জানলে বিভ্রান্তি দূর হয়।
টাইফয়েড রোগটা আসলে কেমন?
অনেকে টাইফয়েড জ্বরকে সাধারণ জ্বর মনে করলেও, সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটা খুব খারাপ দিকে যেতে পারে। মারাত্মক টাইফয়েডে পেটের ভেতরে রক্তপাত হতে পারে বা অন্ত্রে ফুটো হয়ে যেতে পারে। এই জটিলতাগুলো জীবন কেড়ে নিতে পারে বা বড় অপারেশনের দরকার হতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি বছর টাইফয়েডে অনেক মানুষ মারা যায়। তাই রোগটাকে হালকাভাবে নেওয়া মোটেই উচিত না। ঠিক সময়ে চিকিৎসা আর সতর্কতা খুব জরুরি।

সবার জন্য টিকার দরকার আছে কি?
যদি দেশে আক্রান্তের হার ১%-এর নিচে থাকে, তাহলে সবাইকে কেন টাইফয়েডের টিকা দিতে হবে? এটা একটা দারুণ প্রশ্ন, যেটা জনস্বাস্থ্য নীতি যারা বানান, তাদের ভাবা উচিত। যে রোগের আক্রান্তের সংখ্যা এত কম, সেটার জন্য সমাজের সবাই টিকার ধাক্কা কেন নেবে? টিকার সাইড ইফেক্ট (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ফলও তো দেখতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এর পরিষ্কার উত্তর আসা দরকার।
আরো পড়ুনঃ টনসিল ফোলা কমানোর ৭টি সেরা ঘরোয়া উপায়
সবার জন্য টিকা দেওয়ার প্রধান কারণ হলো অনেকের সুরক্ষা তৈরি করা। যদিও টাইফয়েডের জন্য এটা একটু অন্যরকম। টিকার মূল উদ্দেশ্য হলো রোগ ছড়ানো বন্ধ করা এবং যারা দুর্বল, তাদের রক্ষা করা। আক্রান্তের হার একবার বেড়ে গেলে তা দ্রুত মহামারী আকার নিতে পারে। ০.৯১৩% আক্রান্তের হারকে একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনার জন্যই গণটিকাকরণ দরকার হতে পারে। এটা আসলে আগাম সুরক্ষার একটা কৌশল।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নাকি সুরক্ষাঃ কোনটা বেশি?
আপনার আশঙ্কাটা ঠিক যে টিকা নিলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এটা সত্যি, যেকোনো ওষুধ বা টিকারই কিছু না কিছু সাইড ইফেক্ট থাকে। তবে সাধারণত টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো খুব সামান্য হয় এবং তাড়াতাড়ি সেরে যায়। যেমন ইনজেকশনের জায়গায় একটু ব্যথা, অল্প জ্বর আসা বা শরীর দুর্বল লাগা। এই সমস্যাগুলো সাধারণত এক-দু'দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়।
টিকার খুব খারাপ বা মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার ঘটনা খুবই কম। তাই টিকার উপকারিতা (৮৫% সুরক্ষা) আর সামান্য ঝুঁকির (সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) মধ্যে তুলনা করা হয়। টিকার সুবিধা, যা হাজার হাজার মানুষকে বড় রোগ থেকে বাঁচায়, তা সাধারণত এর ছোটখাটো ঝুঁকির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সব টিকার ক্ষেত্রে এই ভালো-মন্দের হিসাবটা করা হয়।
কাদের স্বার্থে এই টিকার কারবার?
আপনি জানতে চেয়েছেন, আসলে কাদের স্বার্থে আমরা সবাই এই টিকা নিচ্ছি? এই প্রশ্নটা প্রায়শই ওষুধ কোম্পানি বা ফার্মাসিউটিক্যালসদের বিশাল ব্যবসার দিকে ইঙ্গিত করে। টিকার ব্যবসাটা অনেক বড় এবং এর অর্থনৈতিক দিকটা অবশ্যই আছে। টিকার দরকার আর ব্যবসার স্বার্থ এই দুইয়ের মধ্যে নৈতিক একটা দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। সবকিছু যদি পরিষ্কারভাবে জানানো হয়, তাহলে এই সন্দেহ দূর করা সম্ভব।
কিন্তু জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে দেখলে, টিকার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের জীবন বাঁচানো এবং দেশের স্বাস্থ্যখাতে খরচ কমানো। একটা অসুস্থ সমাজ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। টিকা বড় রোগ থেকে বাঁচিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সরকারের স্বাস্থ্য খরচ কমায়। তাই, এই টিকাদান কর্মসূচির পেছনে একটা বড় 'স্বার্থ' হলো সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি। এই দিকটাও আমাদের গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
শরীরে জীবাণুর অংশ ঢুকানোর ব্যাপারটা জেনে নিন
আপনি বলেছেন যে, 'গণহারে টাইফয়েড রোগের জীবাণু-খণ্ড আমাদের শরীরে প্রবেশ করাবো'। কথাটা একটু চিন্তার কারণ হতে পারে। তবে বিজ্ঞানের ভাষায়, টিকা হলো একটা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। টিকার মাধ্যমে জীবাণুর দুর্বল বা অকেজো অংশ শরীরে দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো শরীরের ভেতরের রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা।

সরাসরি রক্তে কিছু মেশানো ও ইসলাম ধর্মে কি বলা আছে
আপনি জোর দিয়ে বলেছেন, 'সরাসরি রক্তে কিছু মেশানো সম্পূর্ণরূপে শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ড'। এই ধর্মীয় চিন্তাটি অবশ্যই সম্মান করার মতো। ইসলাম ধর্মে জীবন ও শরীরের যত্ন নেওয়াটা একটা প্রধান কাজ। তবে আধুনিক চিকিৎসায় টিকা সাধারণত সরাসরি রক্তে দেওয়া হয় না। এটা মাংসপেশি বা চামড়ার নিচে ইনজেকশন দিয়ে দেওয়া হয়।
আরো পড়ুনঃ দুবাই যেতে কত টাকা লাগে। ভ্রমণ ভিসার দাম কত?
অনেক ইসলামিক চিন্তাবিদ ও স্কলার জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য টিকা নেওয়াকে জায়েজ (বৈধ) বলেছেন। যদি কোনো ওষুধে হারাম কিছু থাকেও, কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য বা গুরুতর রোগ প্রতিরোধের জন্য সেটা খুবই দরকারি হয়, তবে 'জরুরত' (অপরিহার্যতা)-এর নীতির আওতায় সেটা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। তাই, জীবন রক্ষার জন্য টিকার ব্যবহার ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে যায় না বলেই অনেকে মনে করেন।
শেষ কথাঃ টাইফয়েড গণহারে টিকা দেওয়ার সতর্কতা
টাইফয়েড প্রতিরোধের জন্য টিকা একটা ভালো উপায়, এটা ঠিক। তবে এর পাশাপাশি সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাও কিন্তু খুব জরুরি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং সঠিক স্যানিটেশন (টয়লেট ব্যবস্থাপনা) টাইফয়েড প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। যদি এই মৌলিক বিষয়গুলো ঠিক রাখা যায়, তাহলে এমনিতেই সংক্রমণের হার অনেক কম থাকবে। শুধু টিকার ওপর ভরসা করাটা ঠিক হবে না।
শেষ সিদ্ধান্তটা আপনার ব্যক্তিগত ঝুঁকি এবং জনস্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। যদি আপনি ০.৯১৩% ঝুঁকিও নিতে না চান এবং অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী টাইফয়েড থেকে বাঁচতে চান, তবে টিকা একটা বিকল্প। আবার, কেউ যদি ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত কারণে ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেন, সেটাও তার ইচ্ছা। এই বিতর্কে সঠিক তথ্য জানা এবং ধর্মের নির্দেশনা ঠিকভাবে বোঝা খুবই দরকার।
সার্ভিস আইটির নিয়ম মেনে কমেন্ট করুন প্রত্যেকটা কমেন্টের রিভিউ করা হয়।
comment url