বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে A to Z

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে, ইতালি কাজের ভিসার আসল খরচ কত? দালালের মাধ্যমে গেলে কেন ৯-১৫ লক্ষ টাকা লাগে? 
সরকারিভাবে মাত্র ২০,০০০ টাকায় ইতালি কাজের ভিসা পাওয়ার সঠিক প্রক্রিয়া, ঝুঁকি ও দালালি এড়ানোর সম্পূর্ণ গাইডলাইন। ইতালির নুল্লা ওস্তা এবং ফ্লোসি ডেক্রি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।

পেজ সূচীপত্রঃ বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে A to Z

বাংলাদেশে থেকে ইতালি যাওয়ার মাধ্যম।

ইউরোপের অন্যতম স্বপ্নের দেশ ইতালি (Italy)। এর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার মান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভালো বেতনের হাতছানি আমাদের দেশের বহু তরুণকে ইতালিমুখী করেছে। বিশেষ করে ইতালি সরকার কর্তৃক ঘোষিত  প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক বিদেশী শ্রমিককে কাজের ভিসার (Work Visa) জন্য কোটা দেওয়া হয়। এই কোটা সাধারণত মৌসুমী এবং অ-মৌসুমী উভয় প্রকার কাজের জন্য প্রযোজ্য।

তবে এই সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়েই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এক শ্রেণির অসাধু দালাল বা প্রতারক চক্র। তারা এই ভিসা প্রক্রিয়াকে জটিল ও ব্যয়বহুল হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের মিথ্যা আশ্বাস এবং লোভনীয় অফারে হাজার হাজার বাংলাদেশি পরিবার তাদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। দালালরা এমন একটি চিত্র তৈরি করে, যেন মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া ইতালির ভিসা পাওয়া অসম্ভব।

আপনার কষ্টের উপার্জন যেন কোনো প্রতারকের হাতে না যায়, সেই সচেতনতা তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। চলুন, ইতালির কাজের ভিসার প্রকৃত চিত্রটি জেনে নেওয়া যাক।

 সরকারিভাবে ইতালি কাজের ভিসা: প্রকৃত খরচ ও সরল প্রক্রিয়া 

ইতালির কাজের ভিসার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে "নিয়োগকর্তা-ভিত্তিক" এর অর্থ হলো, আপনি নিজে চাইলেই ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন না; ইতালিতে আপনার একজন বৈধ নিয়োগকর্তা (মালিক) থাকা আবশ্যক। এই প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ দালালমুক্ত রাখার জন্যই ইতালি সরকার সরাসরি নিয়োগকর্তার মাধ্যমে আবেদনের ব্যবস্থা রেখেছে।

 বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়র সকারি প্রক্রিয়ার : নুল্লা ওস্তা 

ইতালিতে কাজের ভিসা পাওয়ার একমাত্র ভিত্তি হলো ইতালীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যুকৃত নুল্লা ওস্তা  বা ছাড়পত্র।

নুল্লা ওস্তার আবেদন: সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ইতালিতে বসবাসরত একজন নিয়োগকর্তা (মালিক), যাকে আপনি নিয়োগ দিতে চান, তিনি তার জন্য নির্ধারিত S ইমেইল থেকে ইতালির স্থানীয় প্রশাসনিক অফিস  ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন।

আরো পড়ুনঃদুবাই যেতে কত টাকা লাগে। ভ্রমণ ভিসার দাম কত?

খরচ: এই আবেদনের জন্য নিয়োগকর্তার সরকারি ফি মাত্র ১৬ ইউরো (যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৬০০ টাকার কিছু বেশি)। আবেদন দাখিলের জন্য কোনো হেল্প ডেস্কের সহায়তা নিলে অতিরিক্ত ৫০ থেকে ১০০ ইউরো সার্ভিস চার্জ লাগতে পারে। এর বাইরে আর কোনো খরচ নেই।

তাৎপর্য: নুল্লা ওস্তা জারি হলে, এটি প্রমাণ করে যে আপনার নিয়োগকর্তা বৈধ এবং ইতালির শ্রম আইনে আপনার কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে ভিসা আবেদন  ফি

নুল্লা ওস্তা পাওয়ার পর আপনি বাংলাদেশে ইতালির দূতাবাসে বা মনোনীত ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে (যেমন VFS Global) ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন।

ভিসা ফিঃ বাংলাদেশে ইতালির দূতাবাসে কাজের ভিসার  ফি।৮,০০০ - ১১,৬০০ টাকা ইউরোর মান এবং ভিসার প্রকারভেদে এটি সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে।

সার্ভিস চার্জঃ  অন্যান্য ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারের  সার্ভিস চার্জ। ৩,৮০০ - ৫,০০০ টাকাএটি ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়াকরণ ফি। 

অন্যান্যঃ অন্যান্যবায়োমেট্রিক, পাসপোর্ট ডেলিভারি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফি। ৫০০ - ১,৫০০ টাকা নগণ্য পরিমাণ ফি।

মোট বৈধ খরচঃ  সরকারি নিয়ম মেনে দালাল ছাড়া সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে, ভিসা ফি এবং সার্ভিস চার্জ মিলে আপনার মোট খরচ ২০,০০০ টাকা থেকে ২৫,০০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এই খরচটিই একজন প্রবাসীর জন্য ইতালির কাজের ভিসার আইনগত খরচ

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে দালাল চক্রের অন্ধকার জগৎ 

যদি সরকারি খরচ এত কম হয়, তবে বাজারে কেন শোনা যায় যে ইতালি যেতে ৪ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লাগে? এই বিশাল অঙ্কের টাকার মূল কারণ হলো সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি একটি অবৈধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন, যেখানে দালালরা সরকারি কোটার সীমাবদ্ধতা এবং মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে একটি প্রচলিত বিশ্লেষণ

দালালদের মাধ্যমে নুল্লা ওস্তা জোগাড় করে নেওয়ার খরচটি নির্দিষ্ট কোনো অঙ্ক নয়। তবে সাধারণ সমাজে এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে লেনদেনগুলো শোনা যায়:

সীজনাল ভিসাঃ এই ভিসার জন্য দালালরা তুলনামূলক কম, ৪ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাবি করে। এই ভিসাগুলোর সময়কাল স্বল্প এবং কাজের ক্ষেত্র মূলত কৃষি বা পর্যটনভিত্তিক হয়ে থাকে।

নন-সীজনাল বা সাধারণ কাজের ভিসাঃ দীর্ঘমেয়াদী এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ থাকায় এই ভিসার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে দালালদের চাহিদা থাকে অনেক বেশি, যা সাধারণত ৯ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ১৮-২০ লাখও ছাড়িয়ে যায়।

গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা: এই অঙ্কগুলো সম্পূর্ণভাবে অবৈধ লেনদেনের ভিত্তিতে তৈরি এবং এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। এই টাকা দালাল বা এজেন্টের ব্যক্তিগত চাহিদা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ওঠানামা করে।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কেন  এত বেশি টাকা নেয়?

নুল্লা ওস্তা "বিক্রি" চক্র: দালালরা ইতালির কিছু অসাধু নিয়োগকর্তা বা এজেন্টের সাথে যোগসাজশ করে। এই নিয়োগকর্তারা আসলে শ্রমিকের প্রয়োজন না থাকলেও অর্থের বিনিময়ে নুল্লা ওস্তার জন্য আবেদন করেন। দালালরা আপনার কাছ থেকে নেওয়া টাকার একটি বড় অংশ সেই নিয়োগকর্তা বা ইতালীয় এজেন্টের হাতে তুলে দেয়, যাকে নুল্লা ওস্তা "কেনার" খরচ হিসেবে দেখানো হয়।

দীর্ঘ কমিশন নেটওয়ার্কঃ দালাল চক্র কেবল একজন ব্যক্তি নয়। একটি ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দালালরা বাংলাদেশ থেকে ইতালি পর্যন্ত একটি দীর্ঘ কমিশন নেটওয়ার্ক  তৈরি করে। গ্রামের দালাল, শহরের এজেন্ট, এবং ইতালিতে থাকা মধ্যস্বত্বভোগী – প্রত্যেকেই তাদের মোটা অঙ্কের কমিশন যোগ করে, যার ফলে চূড়ান্ত খরচ অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যায়।

ঝুঁকি ভাতা ও নিশ্চয়তাঃ দালালরা তাদের 'কানেকশন' ব্যবহার করে এবং ভিসা নিশ্চিত করার মিথ্যা নিশ্চয়তা দিয়ে এই বিশাল অঙ্কের টাকা দাবি করে। তারা এই অবৈধ কাজের ঝুঁকি এবং "গোপন প্রক্রিয়া" পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত "ঝুঁকি ভাতা" হিসেবে এই অর্থ আদায় করে।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে দালালের ফাঁদে পড়ার  ঝুঁকি

দালালের মাধ্যমে ভিসা নিতে গেলে আপনার জীবন ও উপার্জনের ওপর গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হয়:

টাকা হারানোর ঝুঁকিঃ টাকা দিয়েও ভিসা না পাওয়া বা প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন আটকে থাকার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। অবৈধ লেনদেনের কারণে আইনি সুরক্ষা পাওয়া কঠিন।

ভিসা জালিয়াতিঃ দালালরা নকল নুল্লা ওস্তা বা জাল কর্মসংস্থান চুক্তি তৈরি করে প্রতারণা করতে পারে। ধরা পড়লে আপনি কেবল ভিসা হারাবেন না, বরং আইনি জটিলতায় পড়বেন এবং ভবিষ্যতে ইউরোপে প্রবেশ নিষিদ্ধ হতে পারে।


দাসত্বতুল্য কাজঃ অনেক সময় দালালরা কম বেতনে এবং খারাপ কর্মপরিবেশে কাজ করার চুক্তি করে, যার ফলে ইতালিতে গিয়ে প্রবাসীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

দালাল ছাড়া ইতালি কাজের ভিসা পাওয়ার সঠিক  উপায় 

নিরাপদে ইতালি যেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই দালাল চক্রকে দৃঢ়ভাবে "না" বলতে হবে এবং শুধুমাত্র বৈধ পথ অবলম্বন করতে হবে। সচেতনতাই আপনার সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।

 আপনার করণীয় ও নিরাপদ পদক্ষেপঃ

বিশ্বস্ত আত্মীয় বা পরিচিতজনই ভরসাঃ ইতালিতে বসবাসরত কোনো বিশ্বস্ত আত্মীয় বা পরিচিতজনের মাধ্যমে সরাসরি একজন প্রকৃত নিয়োগকর্তা (Employer) খুঁজে বের করুন, যার প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকের প্রয়োজন আছে। এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ পথ।

আরো পড়ুনঃচুল পড়া বন্ধ করার তেল, শ্যাম্পু এবং ঘরোয়া উপায়।

নিয়োগকর্তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করুন এবং নিশ্চিত করুন যে তিনি কোনো মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালকে অর্থ দিচ্ছেন না।

শুধুমাত্র সরকারি তথ্যে আস্থা রাখুনঃ ইতালীয় দূতাবাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, VFS Global-এর ওয়েবসাইট এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পোর্টাল ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিগত তথ্যে ভরসা করবেন না।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে আইনি প্রক্রিয়া যাচাই

নুল্লা ওস্তা পাওয়ার পর অবশ্যই এটি ইতালীয় কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট দূতাবাস থেকে যাচাই করে নিন। জাল নুল্লা ওস্তা দিয়ে ভিসা আবেদন করা অর্থহীন।

বাংলাদেশে ইতালীয় দূতাবাস বা ভিএফএস গ্লোবাল ছাড়া অন্য কোথাও আপনার ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে না।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে ডকুমেন্টেশন প্রস্তুতি

একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত ইউরোপাস সিভি  প্রস্তুত করুন। আপনার সকল তথ্য যেন ইংরেজি বা ইতালীয় ভাষায় সুবিন্যস্ত থাকে।

আপনার শিক্ষাগত ও কর্ম অভিজ্ঞতার সনদপত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত রাখুন। এতে নুল্লা ওস্তা প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হতে পারে।

চুক্তিপত্র পর্যালোচনা:

ভিসা আবেদনের আগে আপনার কর্মসংস্থান চুক্তিপত্র একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে পর্যালোচনা করিয়ে নিন। বেতনের পরিমাণ, কাজের সময়, থাকার ব্যবস্থা—সবকিছু যেন আইনসম্মত হয়।

উপসংহারঃ বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে কত টাকা লাগে A to Z

ইতালি কাজের ভিসা নিঃসন্দেহে একটি সম্ভাবনাময় সুযোগ। কিন্তু এই সুযোগ অর্জনের জন্য অবৈধ লেনদেন করা কেবল আর্থিক ঝুঁকিই বাড়ায় না, বরং আপনার ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নকেও স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দিতে পারে।

আমরা আবারও জোর দিয়ে বলছি:

সরকারি খরচঃ ইতালি কাজের ভিসার আইনি এবং সরকারি খরচ মাত্র ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা (ভিসা ফি ও সার্ভিস চার্জ)।

দালালদের দাবিঃ এর বাইরে ৪ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ বা তারও বেশি টাকা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং দালাল চক্রের পকেটে যায়।

নুল্লা ওস্তার গুরুত্বঃ নুল্লা ওস্তা হলো একটি প্রশাসনিক ছাড়পত্র যা কখনোই টাকার বিনিময়ে কেনা-বেচা করা যায় না।

আমার পরামর্শ  হলো যে. আপনার কঠোর পরিশ্রমের অর্থ যেন কোনো প্রতারকের হাতে না যায়। নিজে সচেতন হোন এবং আপনার পরিচিতদের মধ্যে এই সঠিক তথ্যটি ছড়িয়ে দিন। সঠিক তথ্য এবং বৈধ পথে হেঁটে ইতালির মতো সুন্দর দেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন পূরণ করুন। আশা করি ইতালি যেতে বাংলাদেশে থেকে কত টাকা লাগবে বুজতে পেরেছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সার্ভিস আইটির নিয়ম মেনে কমেন্ট করুন প্রত্যেকটা কমেন্টের রিভিউ করা হয়।

comment url