প্রবারণা পূর্ণিমার ইতিহাস ও তাৎপর্য
২৫৫৯ বুদ্ধাব্দের এই পবিত্র **আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথি** বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে **প্রবারণা পূর্ণিমা** নামে পরিচিত। এটি কেবল একটি চান্দ্র তিথি নয়, এটি ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত বা বর্ষাবাসের সফল সমাপ্তি এবং আত্মশুদ্ধির মহান উৎসব। এই পূর্ণিমা দিনটি বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিক পটভূমি, ধর্মীয় তাৎপর্য ও নৈতিক মাহাত্ম্যকে একসূত্রে গ্রথিত করেছে।
১. বর্ষাব্রত সমাপ্তি এবং 'প্রবারণা' শব্দের বহুবিধ অর্থ
সময়কাল ও বর্ষাব্রতের উদ্দেশ্য:
পবিত্র **আষাঢ়ী পূর্ণিমা** থেকে শুরু করে শ্রাবণী, ভাদ্র (মধু পূর্ণিমা) পেরিয়ে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত দীর্ঘ **তিন মাস** ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘ একটি স্থানে অবস্থান করে কঠোর ধ্যান-ভাবনা ও বিনয় পালনের মাধ্যমে **বর্ষাব্রত (বর্ষাবাস)** অধিষ্ঠান করেন। এই ব্রতের উদ্দেশ্য বহুবিধ:
- বৃষ্টির কারণে সদ্য অঙ্কুরিত বীজ এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র প্রাণীর বিনাশ রোধ করে **বিশ্ব পরিবেশ সুসংরক্ষণ** করা।
- জনকল্যাণে **প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা** করা এবং অহিংস ধর্ম-দর্শনকে সুস্থিতি দান করা।
- সংঘের সদস্যদের নিরবচ্ছিন্ন ধ্যান-ভাবনার মাধ্যমে **চিত্তের উৎকর্ষ সাধন** করা।
'পবারণা' বা 'প্রবারণা' শব্দের তাৎপর্য:
পালি শব্দ 'পবারণা' বা বাংলা 'প্রবারণা'-এর অর্থ অত্যন্ত গভীর ও বহুমুখী। এর আভিধানিক অর্থগুলো হলো—নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, পরিতোষ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ। তবে, এই ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে 'প্রবারণা' হলো: 'প্রকৃষ্টরূপে বারণ করা'। অর্থাৎ, দোষ-ত্রুটি ও অকুশল কর্মকে দৃঢ়তার সাথে বারণ বা ত্যাগ করে শুদ্ধ পথে স্থিত হওয়া। এই তিথিতেই বর্ষাব্রতের সমাপ্তি ঘোষিত হয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি: প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে বুদ্ধদেব স্বর্গে **মাতৃদেবী মায়া** এবং অন্যান্য দেবগণকে ধর্ম দেশনা শেষে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এই কারণেও দিনটি অত্যন্ত পবিত্র ও মহিমান্বিত।
২. ভিক্ষু সংঘের আত্মশুদ্ধি ও শৃঙ্খলা বিধান
প্রবারণা তিথি মূলত **ভিক্ষু সংঘের আত্মশুদ্ধি ও পারস্পরিক ক্ষমা প্রার্থনার** উৎসব। এই দিনে সংঘের সদস্যরা নিজেদের পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করেন:
- আপত্তি দেশনা ও পরিশুদ্ধি: বর্ষাবাস চলাকালীন প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘ সীমায় একত্রিত হন এবং অসাবধানতাবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সংঘটিত দোষত্রুটিগুলো পারস্পরিক **'আপত্তি দেশনা'র** মাধ্যমে পরিশুদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেন।
- বৌদ্ধ বিনয় পর্যালোচনা: এই সময়ে ভিক্ষুরা ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষে সন্নিবেশিত **২২৭ শীল** পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ স্থবিরদের কাছ থেকে এর মাহাত্ম্য ও প্রয়োজনীয়তা বুঝে নেন।
- প্রবারণার অপরিহার্যতা: বুদ্ধের নির্দেশ অনুসারে, বর্ষাবাস সমাপ্তির পর ভিক্ষু সংঘ অবশ্যই একত্র হয়ে **'প্রবারণা'** করবেন—অর্থাৎ পরস্পর পরস্পরের দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং বরণ করে নেবেন। এটি **শাসন পরিশুদ্ধি** ও সংঘের সার্বিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য শর্ত। প্রবারণা সম্পন্ন না হলে সেই বিহারে চীবর দান করা যায় না।
৩. ধর্ম প্রচারের সূচনা এবং মহামৈত্রীর বাণী
প্রবারণা পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষু-ভিক্ষুণী সংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষাব্রত সমাপ্ত করার পরই বিশ্বজুড়ে ধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করেন।
বুদ্ধের ঐতিহাসিক নির্দেশ: এই পূর্ণিমার পরেই করুণাঘন ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সংঘকে গ্রামে-গঞ্জে, নগর থেকে নগরান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়ে **ধর্ম-দর্শন প্রচার করার** বিধান দেন। এই নির্দেশটি বুদ্ধের **মহামৈত্রীর** পরিচায়ক:
"চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, লোকানুকম্পায়..."
(ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, লোকের প্রতি পরম অনুকম্পা পরবশ হয়ে দিকে দিকে এই কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর।)
এই নির্দেশটি বৌদ্ধ ভিক্ষু-সংঘকে সমাজ এবং জগতের কল্যাণে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে।
৪. দানোত্তম 'কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান'
আরো পড়ুনঃ হ্যালোইন: ইতিহাস, উৎযাপন এবং ২০২৫ এর বিস্তারিত।
প্রবারণা পূর্ণিমা সমাপ্ত হওয়ার পরদিন অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত দীর্ঘ **এক মাস** ধরে চলে বৌদ্ধদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব—**কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান**।
- শ্রেষ্ঠ দানোত্তম: বৌদ্ধ দায়ক-দায়িকাদের দ্বারা ভিক্ষু সংঘের উদ্দেশ্যে আয়োজিত এই দানানুষ্ঠানকে **'দানোত্তম'** বলা হয়, যা বিপুল পুণ্য সঞ্চয়কারী।
- আয়োজনের শর্ত: যে মন্দির বা প্যাগোডায় ভিক্ষু সংঘ সাফল্যের সাথে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করেন, কেবল সেখানেই এই দানোত্তম আয়োজন করা যায়। এটি বর্ষাবাসের সফল পরিসমাপ্তির অন্যতম ফল।
- প্রধান অঙ্গ: এই অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অংশ হলো ভিক্ষু সংঘকে **ত্রিচীবর দান** করা।
৫. প্রবারণার নৈতিক আহ্বান ও বর্তমান সময়ের প্রাসঙ্গিকতা
প্রবারণা পূর্ণিমার গভীরতম তাৎপর্য হলো—আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ ও জগতের প্রতি মৈত্রী ও কল্যাণভাবনা বিস্তার করা। এই পবিত্র তিথিতে সকলের প্রতি নৈতিক আহ্বানটি হলো:
- অনৈতিক ও অকুশল কর্মের বীজকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে **লাগামহীন লোভ-লালসার প্রবারণা (পরিত্যাগ)** করা।
- পরচর্চা, পরনিন্দা ও পর-ছিদ্রান্বেষণ তাড়িত **বদ্কর্মসংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে প্রবারণ (ত্যাগ)** করা।
- অহিংসা ও মৈত্রীর স্পন্দমান (Vibrant) মাঙ্গলিক কর্ম-সংস্কৃতির ধারণ, কর্ষণ, লালন ও বাস্তবায়ন করা।
- গোটা প্রাণী-প্রজাতির **শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চেতনার** আবাহন ও প্রতিষ্ঠা করা।
পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা আমাদের জীবনে আত্মসংযম, মৈত্রী ও ক্ষমার বার্তা নিয়ে আসে। এই শুভ তিথি সকলের জীবনে প্রজ্ঞা ও শান্তি নিয়ে আসুক, সেই কামনাই করি।
সার্ভিস আইটির নিয়ম মেনে কমেন্ট করুন প্রত্যেকটা কমেন্টের রিভিউ করা হয়।
comment url