শিশুর ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ।
বর্ষার দিনগুলো যতই মনোরম হোক না কেন, এর সঙ্গে আসে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই রোগটি মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু দ্রুত মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই প্রত্যেক সচেতন অভিভাবকের জন্য ডেঙ্গু সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। এই পোস্টটিতে আমরা শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, রোগের বিভিন্ন পর্যায়, গুরুতর সতর্কীকরণ লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি পর্যায়
ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত তিনটি ধাপে অগ্রসর হয়, যা বোঝা চিকিৎসকের জন্য এবং রোগীর পরিবারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
- ১. জ্বর আসার পর্যায় (Febrile Phase): এই পর্যায়টি সাধারণত ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়। এই সময়ে শিশু উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং মাংসপেশী ও হাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। এই সময় ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো দেখা যায়।
- ২. জটিল পর্যায় বা ক্রিটিক্যাল ফেজ (Critical Phase): জ্বর কমে যাওয়ার পর এই পর্যায়টি শুরু হয় এবং এটিই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। সাধারণত জ্বর শুরু হওয়ার ৩ থেকে ৭ দিনের মাথায় এই অবস্থা দেখা দেয়। এই সময়েই ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (DSS) বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
- ৩. সুস্থ হওয়ার পর্যায় (Recovery Phase): এই পর্যায়ে রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়, প্লাটিলেট সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং শারীরিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে কমে আসে।
শিশুর ডেঙ্গু: ৭টি জরুরি সতর্কীকরণ লক্ষণ
জ্বর কমে যাওয়ার পর অর্থাৎ ক্রিটিক্যাল ফেজে নিচের ৭টি লক্ষণ দেখা দিলে তা মারাত্মক ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। এই লক্ষণগুলো চিনতে পারলে দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
- ১. পেটে তীব্র ব্যথা: শিশু যদি পেটের কোনো নির্দিষ্ট অংশে বা পুরো পেটজুড়ে অসহ্য ব্যথার কথা বলে, যা স্বাভাবিক পেটের ব্যথার চেয়ে আলাদা, তাহলে এটি অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের লক্ষণ হতে পারে।
- ২. অবিরাম বমি: শিশু যদি দিনে একাধিকবার বা প্রতিবার কিছু খাওয়ার পরই বমি করে, তাহলে এটি পানিশূন্যতা এবং জটিলতার ইঙ্গিত দেয়। বমির সঙ্গে রক্ত দেখা গেলে তা আরও গুরুতর লক্ষণ।
-
৩. শরীরের ভেতরের বা বাইরের অংশে রক্তক্ষরণ:
- ত্বকের নিচে ছোট ছোট লাল বা বেগুনি ছোপ দেখা গেলে (পেটে, হাতে বা পায়ে)।
- নাক বা দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত।
- বমির সঙ্গে বা মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
- অস্বাভাবিকভাবে মাসিক শুরু হওয়া।
- ৪. শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া: শিশু যদি দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা বুকে ব্যথা অনুভব করে, তাহলে এটি ফুসফুসে পানি জমার লক্ষণ হতে পারে।
- ৫. অস্থিরতা ও তীব্র ক্লান্তি: জ্বর কমে যাওয়ার পর শিশু যদি অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল, ঝিমিয়ে পড়া বা ঘুম ঘুম ভাব অনুভব করে, এমনকি খেলাধুলায় আগ্রহ না দেখায়, তবে এটি মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ার লক্ষণ হতে পারে।
- ৬. হাত-পা ঠান্ডা ও ঘামে ভেজা: ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমের একটি প্রধান লক্ষণ হলো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। এর সঙ্গে পালস রেট কমে যাওয়া এবং নিম্ন রক্তচাপও দেখা যায়। এই লক্ষণ দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
- ৭. লিভার বা প্লীহার আকার বৃদ্ধি: অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর কারণে লিভার বা প্লীহা বড় হয়ে যায়। পেটের উপরের ডান দিকে ব্যথা বা ফোলাভাব দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আরো পড়ুনঃ থাইরয়েড সমস্যা থেকে মুক্তি: ঘরোয়া উপায় ও আধুনিক চিকিৎসা।
বাড়িতে প্রাথমিক পরিচর্যা ও কখন হাসপাতালে নেবেন?
যদি ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো দেখা যায়, তাহলে বাড়িতেই কিছু পরিচর্যা নেওয়া যেতে পারে।
- শিশুকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার দিন (যেমন: ডাবের পানি, ওরস্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ)।
- জ্বর কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল ব্যবহার করুন। অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
- শিশুকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখুন।
হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত: যদি উপরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণের মধ্যে যেকোনো একটি লক্ষণও দেখা যায়, তাহলে দ্রুততম সময়ে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশা দমন করা।
- ১. জমে থাকা পানি পরিষ্কার করুন: আপনার বাড়ির আশেপাশে, ছাদে বা ফুলের টবে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করুন। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে।
- ২. মশারী ব্যবহার করুন: রাতে বা দিনের বেলায় শিশুকে মশারীর নিচে ঘুমাতে দিন। এটি মশার কামড় থেকে রক্ষা করবে।
- ৩. মশা তাড়ানোর স্প্রে বা লোশন ব্যবহার: শিশুদের উপযোগী মশা তাড়ানোর লোশন ব্যবহার করতে পারেন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে।
- ৪. লম্বা পোশাক পরান: শিশুকে ফুলহাতা শার্ট ও লম্বা প্যান্ট পরিয়ে রাখুন, যাতে তার শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা থাকে।
- ৫. বাড়ির পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুন: ঝোপঝাড় ও আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
আপনার সন্তানের সুস্থতা আপনার সচেতনতার উপর নির্ভরশীল। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানুন, সময় মতো পদক্ষেপ নিন এবং মশা মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলুন।
*গুরুত্বপূর্ণ: এই ব্লগ পোস্টটি শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। এটি কোনো চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। আপনার সন্তানের কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সার্ভিস আইটির নিয়ম মেনে কমেন্ট করুন প্রত্যেকটা কমেন্টের রিভিউ করা হয়।
comment url